The Reconstruction of Religious Thought in Islam- Muhammad Iqbal

তাহলে বার্গসের মতে, সত্তা হচ্ছে ইচ্ছার মতো একটি স্বাধীন, অপূর্ব বর্ণনীয়, সৃজনশীল, সজীব বেগ; একেই আমাদের চিন্তা স্থানভূত করে বস্তুর বহুত্বের আকারে দেখে । এখানে এই মতবাদের পূর্ণাঙ্গ সমালোচনায় প্রবেশ করা যাবে না। তবে এটুকু বললেই যথেষ্ট হয় যে বার্গসের সজীবতা পরিশেষে ইচ্ছা ও চিন্তার এক অনতিক্ৰমণীয় দ্বৈতবাদেই পর্যবসিত হয়। প্রকৃত পক্ষে এটা বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে তার আংশিক ধারণারই ফল । তার মতে, বুদ্ধিবৃত্তি হচ্ছে স্থানভূত করার একটি ক্রিয়া; কেবল পদার্থকে ভিত্তি করে এর গঠন । আর এর আয়ত্তে রয়েছে শুধু কতকগুলো যান্ত্রিক বিভাগ। কিন্তু আমার প্রথম বক্তৃতায় আমি দেখিয়েছি, চিন্তার একটা গভীরতর গতিও রয়েছে । বুদ্ধিবৃত্তি সত্তাকে খণ্ড-খণ্ড নিশ্চল বস্তুতে বিভক্ত করছে বলে মনে হলেও, এর আসল কাজ হচ্ছে অভিজ্ঞতার বিভিন্ন স্তরের উপযোগী শ্রেণিবিভাগের প্রয়োগ করে অভিজ্ঞতার উপাদানগুলোর সমন্বয় বিধান করা। বুদ্ধিবৃত্তি জীবনের মতোই জৈবিক । জৈবিক পরিবৃদ্ধি হিসেবে জীবনের গতির জন্য তার বিভিন্ন পর্যায়ে ক্রমাগত সমন্বয়ের প্রয়োজন। এই সমন্বয়কে বাদ দিলে এটাকে আর জৈবিক বৃদ্ধি বলা চলে না। এই সমন্বয় নির্ধারিত হয় উদ্দেশ্যের দ্বারা; আর উদ্দেশ্য থাকার অর্থই হচ্ছে এই যে তা বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা অনুপ্রবিষ্ট। আবার উদ্দেশ্য না থাকলে বুদ্ধির ক্রিয়াও সম্ভব নয় । সজ্ঞান অভিজ্ঞতায় জীবন এবং চিন্তা পরস্পরের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকে। জীবন ও চিন্তা একত্রে একটি ঐক্যের সৃষ্টি করে।

কাজেই সত্যিকার প্রকৃতির দিক দিয়ে চিন্তা ও জীবনের মধ্যে তফাত নেই । আবার বার্গসের মতে সৃজনশীল স্বাধীনতার দিক দিয়ে সজীব আবেগের অগ্রগতি আশু বা সুদূর উদ্দেশ্যের আলোকচ্ছটায় আলোকিত নয়। কোনো পরিণতির দিকে এ লক্ষ্য নেই; চলাচলে এটা সম্পূর্ণ যথেচ্ছাচারী, অপরিচালিত, উচ্ছল এবং অপূর্বদর্শনীয়। আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার যে বিশ্লেষণ বার্গস দিয়েছেন, তার অ-পর্যাপ্তি আত্মপ্রকাশ প্রধানত এখানেই। সজ্ঞান অভিজ্ঞতাকে তিনি বর্তমানের সঙ্গে আগসর এবং বর্তমানের মধ্যে ক্রিয়াশীল অতীত বলে মনে করেন । চেতনার ঐক্যে যে একটি অগ্রগতির রূপ রয়েছে, বার্গস তা ভুলে যান। জীবনটা হচ্ছে প্রণিধানযোগ্য কার্যাবলির একটা ধারামাত্র। সজ্ঞান হোক, অজ্ঞান হোক, একটা উদ্দেশ্যের পটভূমি ছাড়া প্রণিধানযোগ্য কোনো কাজের ব্যাখ্যা চলে না। এমনকি আমাদের অনুভূতির কাজগুলোও আমাদের আশু স্বার্থ এবং উদ্দেশ্য দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে। মানবীয় অভিজ্ঞতার এই রূপটি সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছেন পারস্যের কবি উরফি। তিনি বলেছেন :

তোমার অন্তর যদি মরীচিকা দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়,
তার জন্যে তুমি তোমার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতার গর্ব কোরো না।
কারণ, দৃষ্টির বিভ্রম থেকে তোমার এই যে মুক্তি
—সে তোমার অপূর্ণ তৃষ্ণারই ফল।

কবি এখানে বলতে চাচ্ছেন যে পানের তীব্র ইচ্ছা যদি তোমার থাকত, তাহলে মরুভূমির বালুকারাশি তোমার মনে একটা হ্রদের ধারণাই সৃষ্টি করত। পানি পানের একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষার অভাব ছিল বলেই এই মরীচিকা থেকে তার অব্যাহতি । জিনিসটা যা আছে, ঠিক সেই আকারে যে তুমি অনুভব করতে পেরেছ, তার কারণ এটা যা নয় সেইরূপে অনুভব করার আগ্রহ তোমার ছিল না। সচেতন প্রবৃত্তিরূপে থাকুক বা অচেতন প্রবৃত্তিরূপেই থাকুক, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যই আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার টানাপোড়েন। একমাত্র ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন ব্যতীত উদ্দেশ্যের ধারণা বোধধগম্য হতে পারে না। অতীতটা নিঃসন্দেহে বর্তমানের মধ্যে অবস্থিত এবং ক্রিয়াশীল, কিন্তু বর্তমানের মধ্যে অতীতের এই ক্রিয়াই চেতনার সবটুকু নয় ।উদ্দেশ্যের উপাদান আমাদের চেতনায় একটা সম্মুখদৃষ্টিরূপেই প্রকাশ পায়। উদ্দেশ্য শুধু আমাদের চেতনার উপস্থিত অবস্থাগুলোর ওপরই রং ফলায় না, আমাদের চেতনার ভবিষৎ গতিপথগুলো উদঘাটন করে। বস্তুত উদ্দেশ্যগুলোই আমাদের জীবনের অগ্রগতি প্রবর্তন করে। কাজেই, আমাদের জীবনের যেসব অবস্থার সম্ভাবনার ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত, একদিক দিয়ে এই উদ্দেশ্যগুলোই তাদের পূর্বাবাস করে এবং তাদের রূপায়ণে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। উদ্দেশ্য দ্বারা নিরূপিত হওয়ার অর্থ, যা হওয়া উচিত, তার দ্বারাই নিরূপিত হওয়া। অতএব দেখা যাচ্ছে, অতীত ও ভবিষ্যৎ এ দুটোই আমাদের চেতনার বর্তমান অবস্থার মধ্যে ক্রিয়াশীল।

আর বার্গসের এ মত গ্রহণীয় নয় যে ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনির্ধারিত। সজাগ চেতনার অবস্থা গড়ে তুলতে সক্রিয় উপাদান হিসেবে স্মৃতি ও কল্পনা—উভয়েরই প্রয়োজন। কাজেই আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণে সিদ্ধান্তটা এই দাঁড়ায় যে সত্তা আইডিয়া বা ভাবের দ্বারা সম্পূর্ণ অনালোকিত কোনো অন্ধ সজীব আবেগ নয় । সত্তার প্রকৃতি সম্পূর্ণই উদ্দেশ্যবাদী।

তবে বার্গস সত্তার উদ্দেশ্যবাদী রূপ অস্বীকার করেছেন; কারণ তাঁর যুক্তি অনুসারে উদ্দেশ্যবাদের দ্বারা কাল অসত্য হয়ে পড়ে। তাঁর মতে, ‘সত্তার সম্মুখে ভবিষ্যতের দ্বার নিরন্তর অবারিত থাকতেই হবে। অন্যথায়, সত্তা স্বাধীন ও সৃজনশীল হবে না। এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই যে উদ্দেশ্যবাদের দ্বারা। পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অনুযায়ী কোনো পরিকল্পনার রূপায়ণ বোঝালে তাতে কাল অসত্য বলেই প্রতিভাত হবে। উদ্দেশ্যবাদ বিশ্বচরাচরকে পর্যবসিত করে একটা পূর্বস্থায়ী শাশ্বত পরিকল্পনা বা কাঠামোর সাময়িক রূপায়ণে—যে পরিকল্পনা বা কাঠামোতে একেকটি ঘটনা পূর্ব থেকে অবস্থিত রয়েছে এবং পালাক্রমে ইতিহাসের কালগত প্রবাহের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। সবকিছুই অনন্তের মাঝে কোথাও পূর্ব থেকে দেওয়া আছে। ঘটনাসমূহের পার্থিব ধারা সেই শাশ্বত কাঠামোর নিছক অনুকৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। যান্ত্রিকতাবাদের সঙ্গে এ ধারণার আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। আর বিশ্বচরাচরের বেলায় যান্ত্রিকতাবাদের প্রয়োগ যে অসার্থক, সে তো আমরা আগেই প্রমাণ করেছি। বস্তুত এ মতবাদ হচ্ছে একপ্রকার প্রচ্ছন্ন জড়বাদ; এতে ভাগ্য বা নিয়তি নিরেট নিরূপণবাদের স্থান গ্রহণ করে; ফলে মানবীয়, এমনকি ঐশী স্বাধীনতারও কোনো অবকাশই আর থাকে না। একটা পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্য রূপায়ণের ধারারূপে গণ্য যে জগৎ, তা স্বাধীন, দায়িত্বশীল নৈতিক কর্মকর্তাদের জগৎ নয়; এটা একটা মঞ্চ মাত্র, অন্তরালবর্তী কোনো আকর্ষণে পুত্তলিকাগুলো সচল হয়ে উঠছে।

তবে উদ্দেশ্যবাদের আরও একটি অর্থ আছে। আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, বেঁচে থাকার অর্থ হচ্ছে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ গঠন ও পরিবর্তন করা এবং তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। যে অর্থে মানসিক জীবন উদ্দেশ্যবাদী তা হচ্ছে এই যে এমন কোনো দূরবর্তী লক্ষ্য নেই বটে যার দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি; কিন্তু জীবনের ধারা বিকশিত ও প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং আদর্শ মূল্যমান ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠছে। আমরা যা আছি, তার বিলোপ সাধন করেই আমরা হই। কবরের ভেতর দিয়েই জীবনের পথ : একে পর এক অনেকগুলো মৃত্যু অতিক্রম করেই জীবন এগিয়ে যায়। জীবনের বিভিন্ন স্তরে আমরা বস্তুর মূল্য নিধারণে আকাশ-পাতাল তফাত করতে পারি, তবু সেসব স্তর এক অবিচ্ছিন্ন জৈবিক সম্বন্ধে পরম্পর আবদ্ধ। মোটের ওপর ব্যক্তির জীবনেতিহাস একটা ঐক্য—পরস্পর খাপছাড়া ঘটনাসমূহের নিছক একটা সমাবেশ নয়। উদ্দেশ্য দ্বারা যদি আমরা বুঝি এমন একটা লক্ষ্য বা সুদূরবর্তী নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল, যার দিকে গোটা সৃষ্টি এগিয়ে চলেছে, তাহলে নিশ্চয়ই জগৎপ্রক্রিয়ায় অথবা কালের বুকে বিশ্বচরাচরের গতির মধ্যে উদ্দেশ্য নেই। কেননা, জগৎপ্রক্রিয়ায় এরূপ অর্থে উদ্দেশ্যের আরোপ করলে তার মৌলিকত্ব, তার সৃজনশীল চারিত্রই হরণ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি কর্মধারার পরিসীমা; এ লক্ষ্য অনাগত লক্ষ্য, তবে তাদের যে আগে থেকেই রাখা হয়েছে, এমন মনে করার কারণ নেই। আগে থেকে আঁকা রয়েছে এমন কোনো রেখারূপে কালের ধারাকে ধারণ করা চলে না। এটা এমন একটা রেখা, যা আঁকা হয়ে চলছে : এ যেন অবারিত সম্ভাবনার বাস্তবায়ন । শুধু এই অর্থে কাল উদ্দেশ্যমূলক যে স্বরূপের দিক দিয়ে এটা নির্বাচনধর্মী এবং অতীতকে সক্রিয়ভাবে রক্ষা ও পরিপূরণ করে কাল এক রকম উপস্থিত উদ্দেশ্য সাধন করে থাকে। এ বিশ্বচরাচর একটা পূর্বকল্পিত ব্যবস্থার পার্থিব রূপায়ণ—এ ধারণার চেয়ে কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গির অধিক বিরোধী আর কিছু আছে বলে আমি মনে করি না । আমি পূর্বেই দেখিয়েছি যে কোরআনের মতে এ বিশ্বজগতের সম্প্রসারণ হতে পারে। এটা একটা ক্রমবর্ধনশীল জগৎ। পূর্ব থেকে পূর্ণরূপে তৈরি করা এমন কোনো বস্তু এটা নয় যা বহু যুগ পূর্বে নির্মাতার হাত থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং স্থানভূত ব্যাপ্তিতে বিস্তারিত হয়ে আছে একটা মৃত জড়পিন্ডের মত- যে জড়পিন্ডের ওপর সময়ের কোনো কাজ নেই এবং সে কারণে তা মূল্যহীন।

আশা করি আমরা এখন -‘এবং যারা আল্লাহর সম্বন্ধে চিন্তা করতে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে ইচ্ছুক তাদের জন্যে তিনিই রাত্রি ও দিনকে পরস্পরের অনুসরণ করার বিধান দিয়েছেন’- এই আয়াতের মর্ম উপলব্ধি করার অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের অন্তরে প্রতিভাত কালানুক্রমে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে পরম সত্তা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা হয়েছিল এমন একটা খাঁটি কালরূপে—যে কালে চিন্তা, জীবন এবং উদ্দেশ্য পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় একটা জৈবিক ঐক্য গঠনের জন্য। একটা সত্তা—সবকিছুকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে আছে এমন একটা বাস্তব সত্তা, সকল স্বতন্ত্র জীবন ও চিন্তার উৎসরূপী সত্তা হিসেবে ছাড়া আমরা এই ঐক্যের ধারণা করতে পারি না। আমি জোর গলায় বলতে পারি যে খাঁটি কালকে সত্তার পূর্ববর্তী বলে ধারণা করাই বার্গসেঁর ভুল । কারণ খাঁটি কাল একমাত্র সত্তা সম্পর্কেই বিধেয়। খাঁটি দেশ এবং খাঁটি কাল কোনোটাই বস্তু এবং ঘটনার বহুত্ব একত্রে ধারণ করতে পারে না। একমাত্র অবস্থায়ী খুদির অনুভবাত্মক ক্রিয়াই অসংখ্য-মুহূর্তে বিভক্ত কালের বহুত্বকে ধারণ করে তাকে একটা সমন্বয়ের সুসংবদ্ধ সমগ্রতায় রূপান্তরিত করতে পারে। খাঁটি কালে বর্তমান থাকাই খুদি বা অহম হওয়া এবং অহম হওয়ার অর্থ হচ্ছে ‘আমি আছি’ বলতে সমর্থ হওয়া। কেবল সেই সত্যি বেঁচে থাকে ,যে বলতে পারে ‘আমি আছি’। ‘আমি আছি’-এই কথা যে যত জোরে বলতে পারে, সেই অনুসারে সৃষ্টির মাপকাঠিতে তার স্থান নির্ধারিত হয়। আমরাও বলি—’আমি আছি’; কিন্তু আমাদের আমিত্ব’ নির্ভরাত্মক; সত্তা ও অ-সত্তা এই দুইয়ের পার্থক্য থেকে এর উদ্ভব।

কোরআনের ভাষায়, ‘চরম সত্তা সমস্ত বিশ্বচরাচরকে বাদ দিয়েও চলতে পারে।’ তার কাছে অ-সত্তা একটা বিরোধী অপর সত্তারূপে প্রতিভাত হয় না। আমরা যাকে প্রকৃতি বা অ-সত্তা বলি, তা আল্লাহর জীবনে একটা অস্থায়ী মুহূর্তমাত্র । আল্লাহর আমিত্ব’ অন্য-নিরপেক্ষ, মৌলিক এবং নিরঙ্কুশ । এরূপ একটা সত্তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব । কোরআন বলে ‘কিছুই’ তার মতো নয়; তবু ‘তিনি শোনেন এবং দেখেন।’ এখন কথা হচ্ছে একটা চারিত্র্য, অর্থাৎ চালচলনের একটা নির্দিষ্ট ধরন ছাড়া একটা সত্তার কথা আমরা ভাবতে পারি না। আমরা দেখেছি যে প্রকৃতি শূন্যে অবস্থিত এক তাল নিছক জড় পদার্থ নয়। প্রকৃতি ঘটনাপুঞ্জের একটা কাঠামো, গতিবিধির একটা সুসংবদ্ধ পদ্ধতি এবং সে কারণে পরম সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গস্বরূপ । মানবীয় সত্তার সঙ্গে চরিত্রের যে সম্বন্ধ, ঐশী সত্তার সঙ্গে প্রকৃতির সেই সম্বন্ধ । কোরআনের ভাষায় এটা আল্লাহর অভ্যাস বা রীতি। মানুষের ভাষায় এটা পরম খুদির সৃজনশীল কাজের অন্যতম পরিচয়। এর অগ্রগতির এক বিশেষ মুহূর্তে এটা সসীম; কিন্তু যে সত্তার সঙ্গে এটা অবিচ্ছেদ্যরূপে সম্পৃক্ত, তা যখন সৃজনশীল, তখন এটাও সম্প্রসারণসাপেক্ষ। ফলে প্রকৃতি সীমাহীন এবং তা এই অর্থে যে এর সম্প্রসারণের কোনো সীমাই চূড়ান্ত নয়। এর সীমাহীনতা অন্তর্নিহিত, বাস্তব নয়। তাহলে প্রকৃতিকে বুঝতে হবে একটি জীবন্ত ক্রমবর্ধনশীল জীবরূপে—যার বৃদ্ধির কোনো চূড়ান্ত বাহ্যিক সীমা নেই। এর একমাত্র সীমা হচ্ছে আভ্যন্তরিক, অর্থাৎ অন্তর্নিহিত সত্তা, যা সমগ্রের উজ্জীবন ও সংরক্ষণ করে। কোরআন বলে : ‘এবং নিশ্চয়ই সীমাটা তোমার প্রভুর দিকে। ’কাজেই আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গি এখানে গ্রহণ করেছি, তাতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটা নতুন আধ্যাত্মিক অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। প্রকৃতির জ্ঞান আল্লাহর কার্যেরই জ্ঞান। প্রকৃতির পর্যবেক্ষণের দ্বারা প্রকৃতপক্ষে আমরা পরম অহমের সঙ্গে একপ্রকার ঘনিষ্ঠতা স্থাপনেরই চেষ্টা করছি। এটা উপাসনারই আরেকটা রূপমাত্র।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে কালকে পাওয়া যাচ্ছে পরম সত্তার মাঝে একটা মৌলিক উপাদানরূপে। অতএব আমাদের সামনে এখন আলোচনা করার রয়েছে কালের অবাস্তবতা সম্পর্কে পরলোকগত ডক্টর ম্যাকটাগার্টের যুক্তিটি। ডক্টর ম্যাকটাগার্টের মতে কাল অবাস্তব; কেননা, প্রতিটি ঘটনাই অতীতের, বর্তমানের এ ভবিষ্যতের। উদাহরণস্বরূপ রানি অ্যানের মৃত্যুর ঘটনা আমাদের কাছে অতীতের, এটা তাঁর সমসাময়িকদের কাছে ছিল বর্তমানের এবং তৃতীয় উইলিয়ামের কাছে ভবিষ্যতের। অতএব দেখা যাচ্ছে, রানি অ্যানের মৃত্যুর ঘটনায় এমন সব বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ হয়েছে, যা পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন । স্পষ্টতই, তার যুক্তি এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হয়েছে যে কালের ক্রমিক প্রকৃতি চূড়ান্ত। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে কালের পক্ষে অপরিহার্য মনে করলে কালকে চিত্রিত করা হয় একটা সরলরেখারূপে, যার একাংশ আমরা অতিক্রম করে পেছনে ফেলে এসেছি; আরেক অংশ এখনো আমাদের সামনে অতিক্রম করার রয়েছে। এতে কালকে গ্রহণ করা হয় একটা জীবন্ত সৃজনশীল সময় হিসেবে নয়, বরং একটা স্থিতিশীল নিরঙ্কুশ সময়রূপে—যা বাইরের পর্যবেক্ষকের কাছে একটা ছায়াচিত্রের ছবিগুলোর মতো পর্যায়ক্রমে প্রতিভাত পূর্ণাঙ্গ জাগতিক ঘটনাবলির সুবিন্যস্ত বহুত্বকে ধারণ করে আছে। আমরা যদি রানি অ্যানের মৃত্যুর ঘটনাকে পূর্ব । থেকে পূর্ণরূপে গঠিত এবং সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষায় ভবিষ্যতের বুকে অবস্থিত রয়েছে বলে মনে করি, তাহলে অবশ্যই বলতে পারি যে এ ঘটনা তৃতীয় উইলিয়ামের কাছে ছিল ভবিষ্যতের।
কিন্তু ব্রড ঠিকই বলেছিলেন যে ভবিষ্যতের ঘটনাকে ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা চলে না। কেননা, অ্যানের মৃত্যুর পূর্বে এ ঘটনার আদৌ কোনো অস্তিত্ব ছিল না । স্বয়ং অ্যানের জীবৎকালেও, তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটির অস্তিত্ব ছিল সত্তার প্রকৃতির মধ্যে শুধু একটা অরূপায়িত সম্ভাবনারূপে। সত্তা এটাকে একটা ঘটনারূপে গ্রহণ করেছিল শুধু তখনই, যখন এই সম্ভাবনা বিকশিত হয়ে হয়ে সেই ঘটনার প্রকৃত সংঘটনের পর্যায়ে এসে পৌঁছাল। তাহলে ডক্টর ম্যাকটাগার্টের যুক্তির প্রতি আমাদের জবাবটি দাঁড়াচ্ছে এই যে ভবিষ্যৎ অবস্থান করছে শুধু একটা মুক্ত সম্ভাবনারূপে, একটা বাস্তব সত্তারূপে নয়। আর একটা ঘটনাকে অতীতের ও ভবিষ্যতের বলে বর্ণনা করলেই যে তাতে অসামঞ্জস্য বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ হবে, তাও বলা চলে না। যখন ‘ক’ নামক একটি ঘটনা ঘটে, তখন তার পূর্বে সংঘটিত হয়েছে এমন সকল ঘটনার সঙ্গে তা একটা অপরিবর্তনীয় সম্পর্কে সম্পৃক্ত হয় । সত্তার আরও বিকাশের ফলে ‘ক’-এর পরে সংঘটিত হয়েছে এমন অন্য ঘটনাবলির সঙ্গে ক’-এর সম্পর্কের দ্বারা এ সম্পর্কের রদবদল হয় না। এসব সম্পর্ক সম্বন্ধে কোনো সত্য বা মিথ্যা প্রতিজ্ঞাই কখনো মিথ্যা বা সত্য হবে না। কাজেই একটি ঘটনাকে একই সঙ্গে অতীতের ও বর্তমানের বলে গণ্য করার মধ্যে যুক্তিগত কোনো অসুবিধা নেই। তবে কাল বিষয়টি যে জটিলতামুক্ত নয় এবং এ সম্পর্কে আরও অনেক চিন্তাভাবনার প্রয়োজন, তা স্বীকার করতেই হবে। সময়ের রহস্য উদঘাটন করা মোটেই সহজ নয়। অগাস্টিন বলেছিলেন, কেউ যদি আমায় কাল সম্বন্ধে প্রশ্ন না করেন, তাহলে কাল যে কী তা আমি জানি; আর কোনো প্রশ্নকারকের কাছে কালের ব্যাখ্যা যদি আমাকে করতে হয়, তাহলে কাল সম্বন্ধে আমি জানি না। এই গূঢ় কথাগুলো যখন উচ্চারিত হয়েছিল, তখন এগুলো যেমন সত্য ছিল, আজও তা তেমনি সত্য।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করতে চাই যে কালটা সত্তার মাঝে একটি অপরিহার্য উপাদানরূপে বিরাজ করছে। কিন্তু প্রকৃত কাল ক্রমিক কাল নয়—যাতে অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যতের পার্থক্য অপরিহার্য। প্রকৃত কাল হচ্ছে খাঁটি কাল, অর্থাৎ পর্যায় বা অনুবৃত্তিহীন পরিবর্তন । ম্যাকটাগার্ট তার যুক্তিতে এ ব্যাপারটির উল্লেখ করেননি । ক্রমিক কাল হচ্ছে চিন্তার দ্বারা খণ্ড-খণ্ড অংশে বিভক্ত প্রকৃত কাল । ক্রমিক কালকে এক রকমের কৌশল (ডিভাইস) বলা যেতে পারে; এর দ্বারাই সত্তার বিরামহীন সৃজনশীল ক্রিয়া সাংখ্যিক পরিমাপে ধরা পড়ে। এই অর্থেই কোরআন বলছে, ‘এবং রাত্রির এবং দিনের পরিবর্তন তারই।’

কিন্তু আপনারা হয়তো জিজ্ঞেস করবেন—পরিবর্তন কি পরম খুদি সম্বন্ধে বিধেয় হতে পারে? মানবীয় জীব হিসেবে আমরা কাজকর্মের দিক দিয়ে একটা স্বাধীন বিশ্বপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমাদের জীবনের অবস্থাগুলো আমাদের কাছে প্রধানত বাহ্যিক । একমাত্র যে জীবনের সঙ্গে আমাদের পরিচয়, তা হচ্ছে বাসনা, প্রচেষ্টা, ব্যর্থতা বা সাফল্য—অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে একটা ধারাবাহিক পরিবর্তন । আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, জীবন হচ্ছে পরিবর্তন এবং পরিবর্তন মূলত অসম্পূর্ণতা। সেই সঙ্গে আবার আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতাই হচ্ছে সকল জ্ঞানের ভিত্তি। কাজেই আমাদের অন্তর-অভিজ্ঞতার আলোক ছাড়া আর কোনো উপায়ে আমরা সত্যসমূহের বিশ্লেষণ করতে পারি না। বিশেষত জীবনের উপলব্ধিতে ঈশ-চিন্তায় মানবমুখিতা, অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে স্রস্টার একটি সাদৃশ্য আছে—এ ধারণা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কেননা, একমাত্র অন্তর থেকেই জীবনের উপলব্ধি করা যেতে পারে। সরহিন্দের কবি নাসির আলী মূর্তির মুখ দিয়ে ব্রাহ্মণকে যথার্থই বলছেন :

তোমার নিজের আকৃতির অনুরূপ করে তুমি আমাকে গড়েছ।
তাহলে তোমার নিজের বাইরে আর কী-ই বা তুমি দেখেছ ?

ঐশী জীবনের কল্পনায় পাছে মানবজীবনের রূপ এসে পড়ে, এই ভয়ে স্পেণে মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক ইবনে হাজম আল্লাহ সম্বন্ধে জীবনের উল্লেখ করতে দ্বিধা করেছিলেন। তাই তিনি চতুরতার সঙ্গে নির্দেশ করেছিলেন যে আল্লাহকে জীবন্ত বলে বর্ণনা করতে হবে এই কারণে নয় যে জীবন সম্বন্ধে আমাদের অভিজ্ঞতা বা ধারণার অর্থে তিনি জীবন্ত; আল্লাহকে জীবন্ত বলতে হবে শুধু এই কারণে যে, কোরআনে এভাবেই তাকে বর্ণনা করা হয়েছে। ইবনে হাজম আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার শুধু ওপর স্তরে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন, অভিজ্ঞতার গভীরতর স্তরের দিকে তিনি দৃষ্টি দেননি। অতএব অপরিহার্যরূপেই তিনি জীবনকে গ্রহণ করেছিলেন একটা ক্রমিক পরিবর্তন, অর্থাৎ একটা প্রতিকূল পরিবেশের প্রতি দষ্টিভঙ্গির পরম্পরারূপে। ক্রমিক পরিবর্তন স্পষ্টতই অসম্পূর্ণতার একটা চিহ্ন। কাজেই আমরা যদি পরিবর্তনের এই ধারণা নিয়ে বসে থাকি, তাহলে ঐশী জীবনের সঙ্গে ঐশী সম্পূর্ণতার সংগতি বিধানের অসুবিধা দুস্তর হয়ে ওঠে।
ইবনে হাজম নিশ্চয়ই মনে করেছিলেন যে আল্লাহর সম্পূর্ণতা রাখা যেতে পারে একমাত্র তার জীবনের মূল্যে। যাহোক এ অসুবিধা থেকে উদ্ধারের একটি পথ আছে। আমরা দেখেছি, পরম অহমই হচ্ছে সমগ্র সত্তা। ফলে তার জীবনের বিভিন্ন অবস্থা সম্পূর্ণ নিরূপিত হয় ভেতরের দিক থেকে। কাজেই অসম্পূর্ণ অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ অবস্থায় এবং সম্পূর্ণ অবস্থা থেকে অসম্পূর্ণ অবস্থায় গতিবিধির অর্থে যে পরিবর্তন, স্পষ্টতই তার জীবনের বেলায় প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এ অর্থে যে পরিবর্তন,তা-ই জীবনের একমাত্র সম্ভাব্য রূপ নয়। আমাদের সজ্ঞান অভিজ্ঞতার সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ক্রমিক কালের বাহ্যরূপের অন্তরালে রয়েছে সত্যিকার কাল । পরম অহমের অবস্থান খাঁটি কালে—যেখানে পরিবর্তন বিচিত্র মানসিক অবস্থার পর্যায়ক্রমরূপে আর থাকে না। তখন এর সত্যিকার রূপ প্রতিভাত হয় ধারাবাহিক সৃষ্টিরূপে, সে সৃষ্টিকে ক্লান্তি স্পর্শ করে না এবং তন্দ্রা অভিভূত করে না, পরম অহমকে পরিবর্তনের এই অর্থে পরিবর্তনহীন বললে তাঁকে চরম নিষ্ক্রিয়তা—একটা উদ্দেশ্যহীন বদ্ধ নিরপেক্ষতা, একটা একান্ত অর্থহীনতারূপে ধারণা করা হয়। সৃজনশীল সত্তার কাছে পরিবর্তনের অর্থ অসম্পূর্ণতা হতে পারে না।
অ্যারিস্টটলই হয়তো ইবনে হাজমের মনে বিশ্বাস জন্মিয়েছিলেন যে সৃজনশীল সত্তার পূর্ণতা হচ্ছে যান্ত্রিক উপায়ে উপলব্ধ অচলতার মধ্যে। এ মত ভুল । সত্তার সপূর্ণতা হচ্ছে তার সৃজনশীল কার্যের বিশালতার ভিত্তিতে, তার সৃজনশীল স্বপ্নের অনন্ত অবকাশের মধ্যে। আল্লাহর জীবনটা হচ্ছে আত্মপ্রকাশ, কোনো আদর্শ বা ‘লক্ষ্যে পৌঁছাবার প্রচেষ্টা নয়। মানুষের বেলায় ‘যা এখনো হয়নি’ বললে প্রচেষ্টা বোঝায় আবার ব্যর্থতাও বোঝাতে পারে। কিন্তু আল্লাহ সম্পর্কে যা এখনো হয়নি অর্থ তাঁর সত্তার অনন্ত সৃজনশীল সম্ভাবনাসমূহের অব্যর্থ রূপায়ণ। গোটা সৃজন-প্রক্রিয়ার মধ্যেও সে সত্তা তার সমগ্রতা বরাবর বজায় রাখে।

“অন্তহীন আত্ম-পুনরাবর্তনে সেই এক-ই বয়ে চলেছে চিরকাল।
অসংখ্য খিলান উত্থিত হয়ে, মিলিত হয়ে।
বিশাল কাঠামোটি ধরে রাখছে স্থিরভাবে।
সুন্দরতম তারকা, নিকৃষ্টতম মৃত্তিকা, তাল—সকল বস্তু থেকেই
প্রবাহিত হচ্ছে বেঁচে থাকার স্পৃহা।
সকল প্রয়াস সকল প্রচেষ্টা আল্লাহর মাঝে রয়েছে চিরন্তন শান্তিরূপে।
–গ্যেটে

তাহলে দেখা যাচ্ছে, দক্ষতার দিক দিয়েই হোক আর অনুভাবক দিক দিয়েই হোক, অভিজ্ঞতার সকল তথ্যের একটা ব্যাপক দার্শনিক সমালোচনা আমাদের এই সিদ্ধান্তে এনে পৌছায় যে পরম সত্তা হচ্ছে বুদ্ধিগতভাবে পরিচালিত একটি সৃজনশীল জীবন। একটা খুদিরূপে এই জীবনের ব্যাখ্যা করলে তাতে আল্লাহকে মানুষের আকৃতির অনুরূপ করে গড়ে তোলা হয় না। এর দ্বারা শুধু অভিজ্ঞতার এই সহজ তথ্যকে স্বীকার করা হয় যে জীবন একটা আকারহীন তরল পদার্থ নয় । এটা একটা সংগঠনকারী ঐক্যনীতি, একটা সংযোজনশীল ক্রিয়া। এটাই প্রাণবান জীবের যাবতীয় বিক্ষিপ্ত প্রবণতাকে একত্রে ধারণ করে এবং একটা গঠনমূলক উদ্দেশ্যের জন্য তাদের একমুখী করে তোলে। স্বভাবের দিক দিয়ে চিন্তা মূলত প্রতীকস্বরূপ। চিন্তার ক্রিয়ায় জীবনের সত্যিকার প্রকৃতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এর দ্বারা জীবনকে শুধু সকল বস্তুর মধ্যে প্রবহমান একপ্রকার বিশ্বজনীন ধারারূপে চিত্রিত করা চলে।

কাজেই জীবন সম্বন্ধে বুদ্ধিগত ধারণার ফল প্রয়োজনই অদ্বৈতবাদমূলক হয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা জীবনের অনুভাবক দিক সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করি ভেতর থেকে। সহজাত জ্ঞানে জীবন প্রতিভাত হয় একটা ঐক্যবিধায়ক খুদিরূপে। এ জ্ঞানকে যত অসম্পূর্ণই বলা হোক না কেন, এটাই সত্তার পরম স্বরূপের প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি। তাহলে অভিজ্ঞতার তথ্যগুলো থেকে সংগতভাবেই অনুমান করা চলে যে সত্তার চরম স্বরূপটা আধ্যাত্মিক এবং একে ধারণ করতে হবে একটা খুদিরূপে। কিন্তু দর্শনের আকাঙ্ক্ষার চেয়ে ধর্মের আকাঙ্ক্ষা আরও উর্ধ্বে চলে যায়। দর্শনটা হচ্ছে বস্তুসমূহ সম্পর্কে একটা বুদ্ধিগত অভিমত। কাজেই যে ধারণা বহুবিধ অভিজ্ঞতাকে একটা নিয়মের অধীনে আনতে পারে, সে ধারণার গণ্ডি পার হয়ে যেতে দর্শন অনিচ্ছুক। দর্শন সত্তাকে দেখে যেন দূর থেকে। কিন্তু ধর্ম চায় সত্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর সংযোগ। দর্শন একটা মতবাদ, কিন্তু ধর্ম হচ্ছে জীবন্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্ক, ঘনিষ্ঠতা। এই ঘনিষ্ঠতা লাভ করতে হলে চিন্তাকে তার নিজের নাগাল পেরিয়ে আরও উর্ধ্বে উঠতে হবে এবং তার সার্থকতা খুঁজতে হবে একটা মানষিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে, যে দৃষ্টিভঙ্গিকেই ধর্ম বর্ণনা করে প্রার্থনা বলে। এই প্রার্থনাই ইসলামের নবীর মুখে শেষ কথাগুলোর অন্যতম।

মুহাম্মদ ইকবাল
ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনে ইসলাম
তরজমা: মোহাম্মদ মোকসেদ আলী এম এ

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *