The Sayings of Muhammad- Sir Abdullah al-Mamun Suhrawardy
বৃটিশ ভারতের বাঙালী মুসলমানদের অন্যতম চিন্তাবিদ স্যার আব্দুল্লাহ আল – মামুন আল -সুহরাওয়ার্দী হযরত মুহাম্মদ স. এর চারশ একান্নটি সুনির্বাচিত হাদিসের সংকলন প্রকাশ করেন এক ‘শ বছর আগে । ১৯০৫ সালে লন্ডনের লুজাক থেকে গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় । ইসলাম ও মুসলিম পুনর্জাগরণে সুহরাওয়ার্দীর এই ইংরেজী গ্রন্থটি মুসলিম ও পাশ্চাত্যের কাছে নতুন ভাবে প্রচার হয়েছে । হযরত মুহাম্মদ স এর চিন্তা , মাহাত্ম্য, উদারতা, ন্যায়পরায়নতা, বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মানবাধিকার , রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন সর্বোপরি ইসলামের সাম্য গণতন্ত্র ও মানবিক মর্যাদার এ এক নতুন গ্রন্থ যা পাশ্চাত্যের দিগন্তে আলো ছড়িয়েছে ।
বাংলার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, কলকাতার সুহরাওয়ার্দী পরিবারের সন্তান আব্দুল্লাহ সুহরাওয়ার্দী জামালউদ্দীন আফগানীর প্যান ইসলামী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯০৩ সালে লন্ডনে ‘প্যান ইসলামিক সোসাইটি অব লন্ডন’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘প্যান ইসলাম’ নামে একটি জার্নালও প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রভূমি থেকে প্রকাশিত ‘প্যান ইসলাম’ জার্নালের মাধ্যমে ইউরোপীয় সংস্কৃতির মুকাবিলায় তিনি ইসলামী সংস্কৃতির গৌরব এবং সভ্যতার উত্থানের পক্ষে কাজ করেন।
‘প্যান ইসলাম সোসাইটি’ ১৯০৫ সালে আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর সংকলিত ‘The Sayings of Muhammad ‘ নামে রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর বাণীর একটি সংকলন প্রকাশ করে। “বইটি পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের মধ্যে এতখানি প্রভাব ফেলে যে, বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক লিও টলস্টয়ের মৃত্যুর পর তাঁর ওভারকোটের পকেটে এ বইয়ের একখানা কপি পাওয়া যায়। কাউন্ট লিও তলস্তয় হযরত মুহাম্মদ স. সম্বন্ধে সঠিক ধারণায় উপনীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন । এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত স্যার আব্দুল্লাহ সুহরাওয়ার্দীর সাথে তলস্তয় পত্র বিনিময় করেন ।”[১]
‘The Sayings of Muhammad ‘ শুধু পাশ্চাত্যের চিন্তা জগতে আলোড়ন তোলেনি ভারতে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাবলীদের চিন্তা ক্ষেত্রেও পৌঁছেছিল। মহাত্মা মোহনদাশ করমচাঁদ গান্ধীর বইটি পড়ার পর যে বক্তব্য দেন তা’ এই গ্রন্থের ভূমিকায় দেওয়া হয় । গান্ধী বলেন “আমি বিপুল আগ্রহের সাথে স্যার আব্দুল্লাহ সুহরাওয়ার্দীর সংকলিত মহানবীর বাণীসমূহ পাঠ করেছি এবং উপকৃত হয়েছি । সে গুলো শুধু মুসলমানদের কাছেই নয় ,গোটা মানব জাতিরই সম্পদ । আমি বিশ্বের সকল মহান ধর্মের সত্যতাতেই বিশ্বাসী । যতদিন আমরা অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে নিজের ধর্মবিশ্বাসের মত শ্রদ্ধা করতে না শিখব ,ততদিন পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না । এক্ষেত্রে মানব জাতির বিভিন্ন ধর্মগুরুর বাণীসমূহ শ্রদ্ধার সাথে অধ্যয়ন করা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি পথ নির্দেশ। “[২]
আব্দুল্লাহ সুহরাওয়ার্দী প্যান ইসলামিজমের জ্বলন্ত আবেগে ভরপুর এক তরুণ যুবক এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিশ্বের মুসলিম শাসনাধীন সকল ভূখণ্ডকে অথবা অধিক সংখ্যায় মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল গুলোকে রাজনৈতিক না হোক অন্তত সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সূত্রে একত্রিত করতে দীপ্ত উৎসাহী ছিলেন । তিনি লন্ডনের প্যান ইসলামিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম সম্পাদক ছিলেন । একদিকে তিনি পাশ্চাত্যে ইসলাম প্রচার করেন অন্যদিকে বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের স্বপক্ষে সক্রিয় থাকেন । সবচেয়ে বড় কথা হলো ইউরোপীয় বস্তবাদীদের চিন্তা জগতে মুহাম্মদ স. এর ন্যায়পরায়নতা,সাম্য- সামাজিক মর্যাদা, একতা- ভ্রাতৃত্ব, আল্লাহর উপর আত্মসমর্পণ , ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা ও উদারতা ছড়িয়ে দেন । তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে মুহাম্মদ স. এর চিন্তা ও জীবন দর্শনের পুনরুত্থান ছাড়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই সংকট নিরসন কোনভাবেই সম্ভব নয় । তাই সভ্যতার সংকট লগ্নে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জরুরত অবশ্যম্ভাবী, কেবল তাঁর চিন্তা ও জীবন দর্শনই পারে অন্ধকার ও বর্বরতাকে পরাভূত করতে ।
“মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনী খোদার জীবনী নয় ,তবে একজন মানুষের জীবনী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তা একান্তভাবেই মানবীয় ভাবাবেগপূর্ণ । “[৩] ইউরোপীয় চিন্তাবিদরা মহানবী স. এর ধর্মকে খ্রিস্টধর্মের প্রতিযোগী হিসেবে বর্ণনা করেন । এমনকি খ্রিস্টান মিশনারীরা মুহাম্মদ স. এর ধর্মপ্রচারের প্রসার ঠেকাতে সক্ষম হননি যার দরুন দ্রুত গতিতে ইসলাম আরব ,এশিয়া ও আফ্রিকায় পৌঁছে যায় । তবে এর কারণ খুঁজে বের করেন ইউরোপীয় চিন্তারবিদেরা । “মুহাম্মদ স. এর সত্যিকার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক সন্দেহ নেই ; তাঁর কর্মজীবনের সমস্ত অংশ জুড়ে তাঁর জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় জানা যায় । সে কর্মজীবনের আকর্ষণ অসাধারণ;সে চরিত্র মানবেতিহাসে সর্বাধিক ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী চরিত্র গুলোর অন্যতম ।”[৪]
অর্থাৎ রাসূল স. মক্কায় যে ধর্মীয় ও সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছিল তার অন্যতম কারণ তাঁর ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী চরিত্র গুণ।
নেপোলিয়ান বোনাপার্ট মুহাম্মদ স. এর চিন্তা ও জীবন দর্শন নিয়ে বক্তব্য দেন এবং ইসলাম নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ । তিনি মুহাম্মদ স. সম্পর্কে বলেন,
“মোহাম্মদ এমন এক প্রবল ব্যক্তিত্ব ছিল যাতে লোকেরা সহজেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতো । ফলে তাঁর ডাকে দলে দলে লোক এসে জমতে লাগলো । এবং অল্প দিনের মধ্যেই এমন এক সম্প্রদায় গড়ে উঠল যারা অল্প ক’ বছরের মধ্যে অর্ধ পৃথিবীতে ইসলামের বিজয় নিশান উত্তোলন করলেন । এবং পৃথিবী থেকে নাস্তিকতা তথা মিথ্যা খোদাদের মুছিয়ে দেবার ব্রত নিলো ।মুসা এবং ঈসার অনুসৃতের দল পনেরো শ’ বছরে যতটুকু না তাদের ধর্মকে বিস্তার করতে পেরেছে ,এরা শুধু পনেরো বছরে তা করে ফেললো।এবং এই সমুদয় উন্নতির একমাত্র কারণ মোহাম্মদের স. মহান ব্যক্তিত্ব ।”[৫]
জাহিলিয়াতে যেমন রাসূলুল্লাহ স. এর জীবন দর্শন ও তাঁর মহান ব্যক্তিত্ব অজ্ঞতা,অন্ধতা দূর করেছিলো ।এবং বর্বরতা, মূর্তি পুজো , সামাজিক অসাম্য ,কন্যা সন্তান হত্যা , দাসত্বের শৃঙ্খল ও ব্যভিচারের মতো জঘন্য কাজ গুলো চিরতরে কবর দিয়েছিল । আজকের এই আধুনিক দাসত্ব কালে , পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শোষণে রাসূল স. এর চিন্তার পুনরুজ্জীবন ছাড়া এই সংকট নিরসন কোনভাবেই সম্ভব নয়। অতএব কুরআন ও রাসূলের স. জীবন দর্শন বাস্তব জীবনে হোক উপলব্ধি ।
তথ্য সূত্র:
১ হাসান সুহরাওয়ার্দী ,(আব্দুল্লাহ সুহরাওয়ার্দীর ভাই)।
২ মোহনলাল করমচাঁদ গান্ধী
৩ লেন পুল
৪ Sketch in his Ethics of the Great Religions- Mr. Gorham’s
৫ নেপোলিয়ান বোনাপার্ট